লালমনির চিত্র ডেক্স:
লালমনিরহাটের অতীত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনেক সমৃদ্ধ। ব্রিটিশ শাসনামলে লালমনিরহাট শুধু পূর্ববঙ্গের বিখ্যাত বেঙ্গল-ডুয়ার্স রেল সংযোগকারী জংশনসমৃদ্ধ রেল শহরই ছিল না, এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ বিমানবন্দরসমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী প্রসিদ্ধ জনপদ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিল এ লালমনিরহাট। এলাকার গুরুত্ব বিবেচনায় ব্রিটিশ শাসনামলে লালমনিরহাটে ঘূর্ণায়মান মঞ্চের থিয়েটার হল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ ঘূর্ণায়মান মঞ্চের থিয়েটার হলকে ঘিরে তৎকালে লালমনিরহাটে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার একটা অনুকূল পরিবেশ বিরাজমান ছিল। সংগত কারণেই বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের মধ্যে লালমনিরহাট সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় অনেক এগিয়ে ছিল। এ ছাড়া লালমনিরহাটের কাকিনায় তৎকালীন ‘কাকিনার জমিদার’ বৃহত্তর রংপুরে শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। লালমনিরহাটের কাকিনার জমিদার রাজা মহিমারঞ্জন রায় চৌধুরী তৎকালীন রংপুরের সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার পাদপীঠ ‘রংপুর টাউন হল’ এবং ঐতিহ্যবাহী ‘রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি’ নির্মাণের জন্য জমি দান করেন। ব্রিটিশ আমলে কাকিনা জমিদারের প্রচেষ্টায় লালমনিরহাটের কাকিনায় থিয়েটার হল, মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, ছাপাখানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে এ অঞ্চলে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশের পথ প্রশস্ত হয়। কালক্রমে কাকিনা তথা লালমনিরহাট সাহিত্য-সংস্কৃতির এক উর্বর ভূমিতে পরিণত হয়।
পত্রিকা প্রকাশনার ক্ষেত্রেও লালমনিরহাটের রয়েছে সোনালি অতীত ঐতিহ্য। বাংলাদেশের তথা পূর্ববঙ্গের প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘রঙ্গপুর বার্তাবহ’ রংপুর থেকে প্রকাশিত হলেও ১৮৫৭ সালের ১৩ জুন লর্ড ক্যানিংয়ের জারিকৃত স্বাধীন মত প্রকাশের অন্তরায় মুদ্রণযন্ত্র আইনের কোপানলে পড়ে এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় কাকিনার জমিদার শম্ভুচন্দ্র রায় চৌধুরী লালমনিরহাটের কাকিনা থেকে ‘রঙ্গপুর দিকপ্রকাশ’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন। কথিত আছে কাকিনার জমিদার শম্ভুচন্দ্র রায় চৌধুরী তৎকালীন কুণ্ডির গোপালপুরের জমিদারের বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘রঙ্গপুর বার্তাবহ’ পত্রিকার মালিকানা ক্রয় করে ‘রঙ্গপুর দিকপ্রকাশ’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, সে সময়ে এটি ছিল একটি প্রথম শ্রেণির সাপ্তাহিক সংবাদপত্র যা সমকালীন সাহিত্যচর্চায় বিশেষ অবদান রেখেছিল।
সংগৃহীত তথ্যমতে জমিদার শম্ভুচন্দ্র রায় চৌধুরী, শ্রীধর বিদ্যালংকার, জগবন্ধু তর্কবাগীশ, গুরুচরণ সরকার, যোগেন্দ্র বিদ্যামনি, গোবিন্দ পঞ্চানন, রাজমোহন সার্বভৌম, বিশ্বেন্দ্র বিদ্যারত্ন, জানকীনাথ সার্বভৌম, তারাশঙ্কর মৈত্রেয়, হরশংকর মৈত্রেয়, ভারতচন্দ্র গুপ্ত, মুন্সী ফজলার রহমান, গোবিন্দ প্রসাদ রায়সহ তৎকালের এ রকম আরও অনেক গুণী লেখকের লেখায় এ পত্রিকাটি সমৃদ্ধ ছিল।
রাজা শম্ভুচন্দ্র রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার দত্তকপুত্র রাজা মহিমারঞ্জন রায় চৌধুরী সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা দানের পাশাপাশি এ পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত রাখেন। এভাবে রঙ্গপুর দিকপ্রকাশ পত্রিকাটি একটি প্রথম শ্রেণির সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসাবে টানা ৪৩ বছর টিকে থেকে লালমনিরহাটে সাহিত্যচর্চায় গুণী লেখকদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানে অসামান্য অবদান রেখেছিল।
এ ছাড়া ১৮৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে (পৌষ, ১২৭০ বঙ্গাব্দে) কাকিনা শম্ভুচন্দ্র মুদ্রণযন্ত্র থেকে ‘রচনাবলী’ নামে একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাখানি বেশ উঁচু মানের ছিল বলে জানা যায়।
এ ছাড়া লালমনিরহাটের প্রথিতযশা কবি শেখ ফজলল করিম কাকিনায় তার নিজ বাড়িতে ‘সাহাবিয়া প্রিন্টিং ওয়ার্কস’ নামে ছাপাখানা স্থাপন করে পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। কবি তার প্রেস থেকে ১৯০৮ সালে ‘বাসনা’ নামে অপর একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন যাতে সমসাময়িক লেখকদের সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হতো। এ ছাড়া কবি ফজলল করিম কাকিনা থেকে ‘জমজম’ (শিশু মাসিক পত্রিকা), ‘কল্লোলিনী’, ও ‘রত্নপ্রদীপ’ (হাতে লেখা সাপ্তাহিক) নামের আরও তিনটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। লালমনিরহাট থেকে এতগুলো প্রকাশনা প্রমাণ করে শতবছর আগে থেকেই লালমনিরহাট জেলা বঙ্গসাহিত্যের বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে।
স্বাধীনতাত্তোরকালে লালমনিরহাট জেলার ভৌগোলিক এলাকা থেকে অনেকগুলো সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এ গুলোর মধ্যে কেয়া, বৃষ্টি ঝরা মেঘ, বিকশিত, অহমিকা, খেয়া, রক্তসূর্য, অস্বীকার, চলমান সাহিত্য পত্রিকা, ত্রৈমাসিক চলমান সাহিত্য পত্রিকা, পথ, বিকাশ, চমক, ইদানীং, মিছিল, সংবর্তক, পূর্ব দিগন্ত, সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, লালপোস্টার, বিপ্লব, সাহিত্য কণিকা ও মুক্ত জগৎ, অম্বিকা, ছন্দে মুক্তি ছন্দে স্বাধীনতা, অরণ্যে রোদন, কথামালা, বোধ, লেখারহাট, মৃত্তিকা, পুষ্পাঞ্জলি, অশ্লীল, চিন্ময়ী, মাসিক রোদ্দুর, সম্প্র্রীতি, প্রচ্ছদ, প্রত্যাশা, উত্তরায়ণ, স্বর্ণামতি-সাহিত্যের ছোট কাগজ, উঠান ইত্যাদি অন্যতম।
লালমনিরহাটে যারা সাহিত্যচর্চা করে খ্যাতিমান হয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম প্রয়াত কবি শেখ ফজলল করিম সাহিত্য বিশারদ।
‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক? কে বলে তা বহুদূর?
মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক-মানুষেতে সুরাসুর’।
-সাবলিল ভাষায় মহৎভাবে রূপায়িত এ কালজয়ী বিখ্যাত চরণ দুটি কবি শেখ ফজলল করীম সাহিত্য বিশারদের ‘স্বর্গ ও নরক’ কবিতার অংশ বিশেষ। কবির এ কালজয়ী কবিতাটি ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় ১৩২১ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এ কবিতা ছাড়াও কবির ‘বঙ্গবাণী’, ‘মালঞ্চ’ ও ‘গাঁয়ের ডাক’ নামক তিনটি কবিতাও স্কুল পাঠ্যপুস্তকে গৃহীত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সিলেবাসে ম্যাট্রিক ক্লাসের জন্য তার কবিতা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
‘পথ ও পাথেয়’ গ্রন্থের জন্য তিনি রৌপ্য পদক পান। ১৩২৩ বঙ্গাব্দে নদীয়া সাহিত্য সভা তাকে ‘সাহিত্য বিশারদ’ উপাধিতে ভূষিত করে। ‘চিন্তার চাষ’ গ্রন্থের জন্য তিনি লাভ করেন ‘নীতি ভূষণ’ উপাধি।
এ ছাড়া অন্যান্য আরও অনেক কবি, লেখক লালমনিরহাটের সাহিত্য অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছেন। এদের মধ্যে প্রয়াত ধর্মনারায়ণ সরকার ভক্তিশাস্ত্রী, শেখ রিয়াজ উদ্দীন আহমেদ, মুন্সী কাজী ফজলুর রহমান, আব্দুল কুদ্দুস, শেখ আমানত আলী, তমিজ উদ্দিন, যাদব চন্দ্র দাস বাণীভূষণ, ডা. সেরাজুল হক, শেখ শাহাদৎ উল্লাহ বসুনিয়া, অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ মিশ্র, শমসের আলী প্রধান প্রমুখ।
সমসাময়িককালে লালমনিরহাট জেলার অতীত ঐতিহ্যকে সমুন্নত রেখে যারা সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রেখেছেন তাদের মধ্যে মুহম্মদ শাহাব উদ্দিন, ড. গৌরাঙ্গ চন্দ্র মোহান্ত, জাকিউল ইসলাম ফারুকী, মাহবুব কামাল, আব্দুর রব সুজন, এস এম মাহবুবর রহমান মনু, মোঃ গোলাম রহমান, মোঃ নজরুল ইসলাম মণ্ডল, মোকতার হোসেন, মোঃ মোস্তফা কামাল চৌধুরী, মোঃ আব্দুল মজিদ মণ্ডল, হাবিবুর রহমান, আলী আকতার গোলাম কিবরিয়া, মকুল রায়, ফেরদৌসী বেগম বিউটি, শ, ম, শহীদ, মুস্তাক মুকুল, নিশিকান্ত রায়, এবিএম রমজান আলী, শ্রী ইন্দ্র কমল রায় দেবসিংহ, আশরাফুজ্জামান মণ্ডল সবুজ, আবু আইয়ুব প্রধান, মোঃ হামিদুল হক মন্টু, বাদল শাহা শোভন, শৌর্যদীপ্ত সূর্য, মনজুরুল ইসলাম, মাহবুব কামাল, আতাউর মালেক, শশধর চন্দ্র রায়, ইরশাদ জামিল, দেলোয়ার হোসন রংপুরী, নাজিরা পারভীন, আব্দুস সালাম, সাইফুজ্জামান সিদ্দিকী চয়ন, আব্দুছ ছালাম, মোঃ মোছলেম উদ্দীন, হাসানুজ্জামান জুয়েল, আব্দুল মান্নান মৃধা, সায়েদুল ইসলাম মিঠু, ইসমত আরা, হাই হাফিজ, আশরাফুল ইসলাম প্রামাণিক, সারমিন আরা হক বিথি, মাজহারুল মোর্শেদ, নবীর হোসেন, আজিজুল হক মোল্লা বাবু, সুবাস চন্দ্র রায়, মজিবর রহমান, কাব্য রাসেল, লীনা রহমান, তিতাস আলম, মুনিম হোসেন খন্দকার প্রতীক, মমিনুল আলম রাসেল, একেএম মইনুল হক, আনোয়ার সাদাত পাটোয়ারী, কল্যাণ চন্দ্র শীল, আলেয়া ফেরদৌসী লাকী, আইটিএম অন্তর, এ কে রাসেল, তরণী কান্ত, হাসানুর রহমান লাজু, মোঃ মুকুল হোসেন, সাবিরা বেগম ডলি, ইকবাল রাবেয়া লারামনি, সাজু রহমান, সুফি মোস্তফা রিপন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, নিরব রায়হান, আরিফ সরকার, আহেদুল ইসলাম, বেনু বেগম বিজলী, সাদিক ইসলাম, আমিনুল ইসলাম মিঠু, স্বপ্না জামান, সুশান্ত কুমার রায়, আতাউর রহমান রতন, হেলাল হোসেন কবির, আজমেরী পারউইন লাবনী, আসমা খাতুন মনি, মাসুদ রানা রাশেদ, আমজাদ হোসেন মাষ্টার, মনসুর সরকার, পাগলা জাহাঙ্গীর, নীলকমল মিশ্র, রিয়াজুল ইসলাম, রাজু রহমান দুলু, রয় অর্ক, বাদল আশরাফ, হাফিজুর রহমান হাফিজ, পিকে বিক্রম, ময়জুল ইসলাম ময়েজ, সুমন বসুনিয়া, জামাল হোসেন, মাখন লাল দাস, ফারুক আহমেদ সূর্য, শাহাজাহান হোসেন লিপু, ফারুক আলম প্রমুখ অন্যতম।
লালমনিরহাট জেলায় সাহিত্যচর্চা ও বিকাশের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি সংগঠন গড়ে ওঠে। এ সংগঠনগুলোর মধ্যে একতা সাহিত্য সংসদ, জেলা সাহিত্য পরিষদ, সাহিত্য পরিষদ, লালমনিরহাট, বনলতা সাহিত্য সংঘ, বন্ধন সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংসদ, কবি সংসদ বাংলাদেশ, বাণীনগর রেনেসাঁ ক্লাব, সারপুকুর যুব ফোরাম পাঠাগার, বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ, বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শিশুকিশোর মেলা, আরশী নগর, রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষদ লালমনিরহাট জেলা শাখা, স্বর্ণামতি নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্র, বিশ্ব কবি মঞ্চ, লালমনিরহাট সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদ অন্যতম। লালমনিরহাট সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদ নামের সংগঠনটি জেলার পাঁচটি উপজেলায় পৃথক পাঁচটি শাখা কমিটি গঠন করে জেলার প্রায় শতাধিক লেখক কবিকে সংগঠিত করে সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা ও বিকাশে নেতৃস্থানীয় সংগঠন হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর
Leave a Reply